বাংলার নায়াগ্রা নাফাখুম জলপ্রপাত

নিজেকে এই প্রথমবারের মত কুয়োরব্যাঙ মনে হচ্ছে। কলকল শব্দে ৩০ ফুট উপর হতে পানি এসে পড়ছে মাথার উপর। আর আমি ব্যাঙের মত ঢ্যাবঢ্যাব করে থাকিয়ে আছি চারপাশ। অথৈ জলধারা আছড়ে পড়ে দুধ সাদা ফেনা তুলছে। পানকৌড়ির মত ডুব দিয়ে আছি নাফাখুম জলপ্রপাতে।

বাংলাদেশের নায়াগ্রা খ্যাত সেই লেভেলের একটি জলপ্রপাত। চোখে না দেখে বিশ্বাস করা সত্যিই কঠিন।

ট্যুরের শুরুটা ছিল, ২৪ শে মার্চ, শুক্রবার। এর কয়েকদিন আগে যা যা দরকার ছিল গুছিয়ে নিলাম। স্বপ্নময় বাংলাদেশ টিমে আমাদের ভ্রমণসঙ্গী ১১ জন। পরিচিত বলতে কামাল ভাই ও ইমন ভাই। সকাল ৯ টা ৩০ মিনিটে চট্টগ্রামের ক্রসিং মোড় হতে বাসে উঠে সবার সাথে আলাপে বুঝে গেলাম বেশ মজা হবে। আমাদের যাত্রা শুরু হলো বাস ছাড়ার সাথে সাথেই।

এই ভ্রমণের মূল গন্তব্য হলো বান্দরবানের নাফাখুম ঝর্ণা, রেমাক্রি আর তিন্দু।।
বিকাল ৩ টার পর থেকে রেমাক্রির দিকে কোন ইঞ্জিন নৌকা চলবে না। যেভাবেই যাই আমাদের বিকাল ৩ টার আগেই থানছি পৌঁছে নৌকা নিয়ে বের হয়ে যেতে হবে আমাদের গন্তব্যের দিকে। তাই মনের মধ্যে একটা সংশয় ছিলো এই নিয়ে। তখন আমাদের রুট প্ল্যান হলো, বান্দরবান-চিম্বুক পাহাড়-নীলগিরি-থানছি-পদ্মমুখ-তিন্দু-বড় পাথর-রেমাক্রি-নাফাকুম ।

সারাদিন দৌড়ের উপর থাকতে হবে, বাস ছাড়ার পর চেষ্টা করলাম কিছুটা ঘুমাতে। কিন্তু সব সময়ের মতো ঘুমের দেখা পেলাম না। পাশের যাত্রী ইমনের সাথে গল্প করে আর গান শুনেই সময় যেতে লাগলো। আজ রাতে মারমা পাড়ায় থাকব এই ভেবে রোমাঞ্চিত ছিলাম।
বান্দরবানে নামলাম ১২ টায়। ৩ টার আগেই থানছিতে থাকতে হবে, তাই তাড়াহুড়া করে পরোটা ডিম দিয়ে নাস্তা করে দ্রুত চান্দের গাড়িতে সবাই উঠে গেলাম।

বান্দরবান থেকে থানচির দূরত্ব ৭৬ কিলোমিটার। এখন পর্যন্ত আমার সবচেয়ে প্রিয় সড়ক পথ। আঁকা বাঁকা, উঁচু নিচু রাস্তা ধরে একটার পর একটা পাহাড়কে পাশ কাঁটিয়ে চলতে শুরু করেছে চাঁন্দের গাড়ি। এই যাত্রার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রতিটি দৃশ্যই দেখার মতো। চিম্বুক নীলগিরি দেখে চলছি পাহাড়ি পথে।
গল্প, চিল্লানো আর গাড়িতে দাঁড়িয়ে হাওয়া খেতে খেতে ৪ টায় পৌঁছালাম থানচি বাজারে।

আগে ঠিক করে রাখা গাইড ম্লায়ং প্লু মারমা সাথে সাথে হাজির।
বললো ১ ঘন্টা লেইট।
৩ টার পর এখান হতে রেমাক্রি যাওয়ার আর কোন সুযোগ নেয়।

ট্যুরিস্ট এর চাপ থাকায় আর্মি বিজিবি ক্যাম্প গুলোতে রিপোর্টের কাজ ও থানছি থানা হতে কোন ভাবে রিকুয়েস্ট করে শেষমেশ অনুমতি পাওয়া গেল।

অল্প কিছু নাস্তা আর দরকারি কিছু কেনাকাটা করে নিলো সবাই। এই দিকে টিম লিডার মানিক ভাই ব্রিফ দিয়ে সবাইকে স্বচ্ছ ধারণা দিয়ে দিলেন।

আগেই ঠিক করে রাখা ২টা ছোট ইঞ্জিন নৌকা দিয়ে যাত্রা শুরু হলো সাঙ্গু নদী দিয়ে। গন্তব্য রেমাক্রি, যেখান থেকেই শুরু হবে আমাদের ট্রেকিং। সাঙ্গু নদী আর তার চারপাশের রূপের কথা আর কি বলবো, এক কথায় যাকে বলে অপরূপ। এই সময় পানির খুবই স্বল্পতা আর নৌকা চলছে উপরের দিকে স্রোতের বিপরীতে। নিচে ছোট বড় পাথরের আস্তরণ, একটু পর পর নৌকার তলা পাথরে আঁটকে যাচ্ছে। সবাইকে নেমে যেতে হচ্ছে, মাঝি আর তার সহকারী নৌকা ঠেলে একটু পানি বেশি আছে নিয়ে যাচ্ছে, আমরা আবার উঠছি নৌকায়। পাহাড়ে সবুজের কমতি নেই। দুইপাশে পাহাড়, মাঝ দিয়ে বয়ে চলা সাংগু। ছবির মতো চারপাশ দেখতে দেখতে ঘন্টাকানেক পরেই সন্ধ্যা হয়ে এল।

২.

তিন্দু -রেমাক্রি

সন্ধ্যা হয়ে এলে মাঝিরা পড়ল বিপদে। অন্ধকারে নৌকা বার বার আটকে যাচ্ছে পাথরে। আরো ২ ঘন্টার পথ বাকি।
একপর্যায়ে নৌকা আটকে যাওয়ায় নৌকা থেকে নামতে হল সবাইকে। ৩০ মিনিট পাহাড় দিয়ে হেঁটে এরা তিন্দুর মুখে যাবে। আমি আর ২ মাঝি রওয়ানা দিলাম নৌকায়। দুপাশেই উঁচু পাহাড়। ভয়ে গা ভারী হয়ে আছে। ১০ মিনিটে তিন্দুর মুখে চলে এলাম। পেছনে পুরো টিম এখনো পাহাড়ে।
ভয় পেলে এক মারমা মাঝি সাহস দিয়ে কথা বললেন। নৌকা থেকে নেমে একটা টং দোকানে চা খেলাম।
সবাই এলে আবার যাত্রা শুরু হলো।

আর ঘন্টা খানেক পথ, তারপরই পৌঁছে যাবো রেমাক্রি। হঠাৎ সামনে দেখি খালের মাঝে ভয়ংকর সদৃশ বড় বড় পাথর দাঁড়িয়ে আছে। রাজা পাথর, বড় পাথরে খাল ভরপুর। অন্ধকারে টর্চের আলোয় দেখে মুগ্ধ হলাম।

ঘণ্টাখানেক আসার পর অবশেষে এক পাহাড়ের উপরে আলোর দেখা পেয়ে বুঝতে পারলাম আমরা চলে এসেছি রেমাক্রি বাজারের নিচে। পাড়ায় গিয়েই গোসল দিয়ে ফ্রেশ হয়ে রাতের খাবার খেতে এক মুহুর্ত দেরী করলাম না। খাবারের মেন্যু ছিলো ভাত, ডাল, আর শক্ত মুরগীর মাংস দিয়ে। পেটে একটুও জায়গা খালি না রেখে ভরে নিলাম। জীবনে এত খাওয়া কমই খেয়েছি।

উঠোনে আড্ডা জমলো, শুরু হলো গানের আসর। এইদিকে উঠোনের আরেক পাশে একদল বসে গেলো খাসীর মাংসের বারবিকিউ করতে। এক টং ঘরে একদল মারমা যুবক গানের তালে তালে মদ খাচ্ছে। দেখে অবাক হলাম…

আমাদের গ্রুপে একটার পর একটা গান, সবার গলা মিলানো, আর উঠোনে শুয়ে আকাশের হাজার হাজার তারা দেখতে দেখতে মনের উঠোনে খেলা করছিলো অনেক কিছুই। জীবনের অর্থ কী বুঝার মতো কঠিক ব্যাপার গুলোও মাথায় ঘুরছিলো। জীবন সুন্দর কি না জানি না, তবে জীবনকে উপভোগ করতে চাই আমার মতো এমন ভাবনার প্রতি আত্মবিশ্বাস বাড়ছিলো।

৩. রেমাক্রি থেকে নাফাখুম

রেমাক্রি খাল ধরে ট্রেইলটা মজার। এই কখনো মনে হচ্ছে মরুভূমির উপর, কখনো মনে হচ্ছে ছোট ছোট পাথরের দুনিয়ার উপর, কখনো নল খাগড়ার মাঝ দিয়ে কখনো বিশাল বিশাল সব পাথরের ফাঁক গলে, কখনো বা পাহাড়ের কিনারা ঘেষে চিকন পাথুরে দেয়াল দিয়ে। সামনে যতই যাচ্ছিলাম পাথর গুলোর আঁকার ততই বড় হচ্ছিলো।

ঝিরিপথ সবসময় আমার পছন্দ। তুলনামূলক সহজ ট্রেইল। চারপাশের দৃশ্য সবসময়ের মতো মনোরম। ঝিরির কিছু জায়গায় শুকনো, কোথাও বা কোমর সমান পানি জমে আছে, দুইপাশেই পাহাড়, ছোট বড় পাথর, পিচ্ছিল পথ, গাছপালা, আলো আধারের খেলা। একেক জনের হাঁটার গতির কারণে কিছুক্ষণ পরেই কয়েক গ্রুপ হয়ে গেলো। কেউ সামনে কেউ পিছনে। নির্জন দুপুরে পাহাড়ের গরম স্বাভাবিক ভাবেই বেশি থাকে কিংবা বেশি লাগে। ঘামছি, শরীর ভিজছে, আবার শুকাচ্ছে। গলা শুকিয়ে গেলে বোতল থেকে এক চুমুক স্যালাইন খাচ্ছি। কতদূর হেঁটে কিছুক্ষণ বিশ্রাম। আপ ট্রেইল না হওয়ায় সবাই বেশ আনন্দেই চলছি। চারপাশ দেখার সময় কমই পাওয়া যায়, সবসময় সজাগ দৃষ্টি রাখতে হয়ে পথের উপর, কোথায় পা ফেলছি তার উপর। হঠাৎ জুতায় স্লিপ খেয়ে আছাড় খেলাম পাথরে, হাতে রাখা মোবাইল বাঁচাতে গিয়ে ঝিরির পানিতে পড়েই যাচ্ছিলাম, ভাগ্যিস বড়সড় একটি লতা ধরে সামলে নিলাম। ভাগ্য ভালো কোন ব্যথা পেলাম না এইবার। ব্যাগের ওজন যত কম রাখা যায় ততই মঙ্গল। সেইভাবেই আমি ব্যাগ গুচিয়ে এনেছিলাম।

কিছুক্ষণ হাঁটার পরই সামনে পড়লো চিংথোয়াইঅং হেডম্যান পাড়া। সুন্দর পাড়া, অন্য পাড়া গুলোর তুলনায় কম আদিবাসীর বসবাস। একটা দোকান পেলাম, পর্যটকদের জন্য অল্পকিছু পসরা সাজিয়ে বসে আছে। কিছু খেয়ে চিংথোয়াইঅং হেডম্যান পাড়া থেকে বের হয়ে গেলাম।

চারপাশের প্রকৃতি আর রেমাক্রি খাল মিলেমিশে সুন্দর সব ল্যান্ডস্কেপ চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। যখনই কোথাও বিশ্রামের জন্যে থেমেছি, পাশেই থাকা খালের স্বচ্ছ পানিতে চুমুক দিয়েছি।

গত ২ ঘন্টা ধরে হেঁটে আসা পথে আপ ট্রেইল ছিলো অল্পই। বাকি পথ টুকু আপ আর ডাউন ট্রেইল। নাফাখুমে যাবার আগে এই প্রথম বার মোটামুটি একটা আপ ট্রেইল পাড়ি দিতে হবে। ১০ মিনিটের এই আপ ট্রেইলে উঠেই ফুসফুসে অক্সিজেনের অভাব অনুভব করছিলাম। পায়ের লিগামেন্ট গুলো মনে হচ্ছিলো যে কোন সময় ছিড়ে যাবে। আস্তে ধীরে কিছুটা সয়ে যাবে। সামনের পাড়ায় উঠেই এক আদিবাসীর ঘর থেকে ঠান্ডা পানি খেয়ে শরীর ঠান্ডা করলাম। একে একে সবাই চলে আসলো, আর এই প্রথম অনেকেই প্রথমবারের মতো বুঝলো পাহাড়ে উঠা এত সহজ নয়। অনেকদিন পর পাহাড়ে উঠতে গিয়ে বুঝলাম আমার অবস্থাও এত ভালো নয়। সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে মাথার উপর সূর্য আর প্রচন্ড গরম।

কিছুদূর এগিয়ে একটা ডাউন ট্রেইলে যেতেই অন্যগ্রুপের একজনের মাথা ঘুরাতে লাগলো, টলতে টলতে হাটছিলো। অতীত অভিজ্ঞতায় থেকে উনাকে দেখেই বুঝলাম ডিহাইড্রেশন এর সমস্যা হচ্ছে। উনার ব্যাগ কাঁধে নিয়ে আস্তে ধীরে ধরে ধরে সামনে এগুতে লাগলাম। ঐ মুহুর্তে কিছুটা ভয় লাগছিলো। পানি না পেলে খারাপ কিছু হতে পারে। ভাগ্য ভালো কিছুদূর সামনে এগিয়ে যেতেই একজন চিৎকার দিয়ে জানালো এক গর্তের মধ্যে অল্প জমে থাকা পানি পাওয়া গেছে। পানিতে ময়লা নাকি ব্যাঙ্গাছি আছে তা দেখার সময় নেই, বোতল ভরে স্যালাইল গুলিয়ে ঐ ভাইকে খাওয়ালাম। শরীর মুছিয়ে কিছুক্ষন রেস্ট নেবার পর উনি কিছুটা ঠিক হলো।
ঐদিকে পিছনে যারা আছে তাদের কোন খবর নেই। সময় যেতে লাগলো আমরা অপেক্ষা করতে থাকলাম। মাথার ভিতর দুঃশ্চিন্তা, ওদের কারও কিছু হয় নি তো। যোগযোগ করার কোন উপায় নাই, ফিরতে পথে যে কেউ যাবে তার শক্তিও নেই।

আবার শুরু হলো হাঁটা, কতটুকু পথ বাকি গাইডকে জিজ্ঞেস করলে বলে আর একটু আর একটু। কিন্তু একটু আর শেষ হয় না।

সামনের একটি ঝোপে পা দিতেই মনে হলো কি জানি নড়লো, একটু পাশে আলো ফেলতেই প্রথমবারের মতো সাপের সাথে দেখা হয়ে গেলো। তিন হাতের মতো লম্বা, অপিরিচিত সাপ। পাশে থাকা এক ভাইকে বলতেই ইশারা দিলেন চেপে যেতে। সাপ দেখলে অনেকেই ভয় পেতে পারে তাই চুপ মেরে সামনের দিকে এগুতে লাগলাম। আমি ভুলে গেলাম একটু আগে আমার পা থেকে ৩-৪ হাত দূরে কি দেখেছি। সামনে কাঁধাময় ঝিরি আসলো, সাথে পিচ্ছিল পাথর। বেশ কিছুক্ষণ হাঁটার পর পানির শব্দ পেলাম। গাইড কে জিজ্ঞেস করতেই বললো সামনেই নাফাখুম।

প্রায় ৩ঘন্টা হাঁটার পর দূর থেকেই নাফাখুমের গর্জন শুনতে পেলাম। ঝর্ণার পানি পতনের শব্দের চেয়ে মধুর শব্দ কমই আছে। গিয়ে আর দেরী না করে নেমে গেলাম ঝর্ণার উপরের স্টেপে। সেখান থেকে পানির স্রোতে ভেসে পড়লাম ঝর্ণার পানির সাথে নিচের জলাধারে। পানি কম থাকায় ভালই হয়েছে, যাওয়া যায় ফলের নিচেও। চিৎকার, উল্লাস, উপর থেকে লাফ, ঝর্ণার পানি দিয়ে শরীর ম্যাসেজ সবই হলো। যেন পানি ছেড়ে উঠতেই মন চায় না। আমার দেখা সেরা একটি জলপ্রপাত। অদ্ভুত..অনিন্দ্য সুন্দর।

২ ঘন্টা কাটালাম পানিতেই। এবার উঠে আবার পথ ধরতে হবে, ২ টার আগেই রেমাক্রি পৌছাতে হবে। যদিও এই ঝর্ণা ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করছিলো না।

“অনেকবার পাহাড়ে উঠতে গিয়ে মাঝপথে তুষার ঝড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে প্রতিজ্ঞা করেছি এবারই শেষ ,পাহাড়ে উঠা ছেড়ে দেব । কিন্তু তারপর বাড়িতে ফিরে বিছানায় যখন শুয়েছি আমার জানালায় আবার ভেসে উঠেছে দূরের হিমালয়ের ঐ চূড়া । মনে হয়েছে চূড়া যেমন আমায় ডাকছে । আমার মন আনচান করে উঠেছে । আবার দড়িদড়া নিয়ে ছুটে গেছি ঝড়ের মধ্যে ।”

-এভারেষ্ট বিজয়ের আগে একদিন এমনই বলেছিলেন শেরপা তেনজিং ।

আজ নাফাখুম ছেড়ে যাচ্ছি, আবার আসব। দেখে আাসার অনুরোধ রইলো।