“ফুরমোন পাহাড় সামিট”

ভোর হতেই ট্রেকিং, বিজিবির আপত্তি, পিটে ১৫ কেজি ওজনের ব্যাগ, টিম লিডারের নিষেধ, ২ জনের ডিহাইড্রেশন, ৮৫ ডিগ্রি ঢালু পাহাড় , শান্তিবাহিনীর ভয়….

সবমিলিয়ে ফুরমোনের চূড়ায় নীলের স্বপ্নময় বাংলাদেশ টিম।সকাল ৯ টা। বাইকে করে টিমের সবাই এসে হাজির হলাম রাঙ্গামাটির মানিকছড়ির বিজিবি ক্যাম্পে।


উদ্দেশ্য ফুরমোন পাহাড়ে উঠার নিরাপত্তা তলব করা। টিম লিডার মানিক ভাই এবং অভিযাত্রী কামাল ভাই ও জাহেদ ভাইসহ বিজিবি সদস্যদের সাথে কথা বলছি..


আমাদের কথা শুনে চুল গোঁফ পাকা এক বিজিবি অফিসার বলে উঠলেন:

“পাহাড় অশান্ত, আমরা না করছি না, নিজেদের রিস্কে যেতে পার। তবে পাহাড়ের পরিস্থিতি ভয়ানক, শান্তিবাহিনী উত পেতে আছে। বাকিটা তোমাদের ইচ্ছা”

অফিসারের কথা শুনে সবাই থ’

পরে এক রাউজানের বিজিবি অফিসার আবচার আমাদের সাহস দিয়ে আশ্বাস দিলেন। তখনি নিজে ফুরমোনের আরেকটি ক্যাম্পে ফোন করে নিরাপত্তার তাগিদ দিলেন। আমাদের নম্বর ও নিলেন।

নিরাপত্তার জন্য সাপছড়ি দিয়ে ট্রেকিং না করে আমরা ফুরমোন পাড়ার পাদদেশে ফুরমোন পাড়া থেকে ট্রেকিং শুরু করলাম।

সাথে আছে টিম লিডার মানিক ভাই, জাহেদ ভাই,ইমন,ওসমান, মানিক২ ও কামাল ভাই।

সাথে নেয়া হল ১৪ লিটার পানি,পাউরুটি,পপকর্ন,কলা,চকলেট,কেক, আমসত্ত্ব, স্যালাইন ও প্রয়োজনীয় মেডিসিন।

পানি ছাড়া পাহাড়ে উঠা একেবারে অসম্ভব। পানি না থাকলে বড় বিপদও হতে পারে। তাই আমি আরো ২ লিটার এক্সট্রা নিয়েছিলাম ব্যাগে।

ট্রেকিং শুরু..

পাহাড়ি উঁচু-নিচু রাস্তা আমাদের রোমাঞ্চিত করছিল। শুরুতেই ফুরমোন পাড়া। একটা মাত্র দোকান। ৮০ বছরের বৃদ্ধা মহিলা দোকানের সওদাগরি করছে। পরনে একটি ব্লাউজ ও ঘাগরা। আমাদের দেখে মিটমিট করে তাকিয়ে আছে।

প্রথম দিক হতে খুব উৎসাহ নিয়ে হাঁটছিলাম। ফুরমোন পাড়া পার হয়ে ফুরমোনের কাছে এসে পৌঁছালাম। চোখের সামনে বিশালাকার ফুরমোন। ভয় করছে চূড়া দেখে.. বিশাল মোন..


উঠার পথে আশপাশে প্রচুর শিলাস্থর শিলা স্তরগুলি বেশির ভাগই ধীর বেলে পাথর, বেলের শেল ও শুথু শেল যা টারশিয়ারী যুগের। এ স্তরগুলি ভাঁজ, চ্যুতি, জয়েস্টসহ অন্যান্য ভূ-তাত্ত্বিক চিহ্ন বিশিষ্ট রীজ ক্রেষ্ট। মূল রীজগুলির মাঝখানের সিনক্লাইন বা ট্রাফগুলি আনুপাতিক হারে নীচু।


‘আরাকান ইয়োমার’ বর্ধিকরূপ রাঙ্গামাটি এই পর্বত শ্রেণী। এ জেলার শিলা স্তরগুলি পাললিক শিলার অন্তর্ভূক্ত।


ফুরমোনের চড়াই-উৎরাই পার হচ্ছি একের পর এক সিনক্লাইন ক্রস করে। কিছুক্ষণ হাঁটার পর অনেকের অবস্থা নড়বড়ে। আরো আধাঘণ্টা হাঁটার পর প্রায় সবাই বসে পড়ল এবং দু-একজন শুয়েও পড়লো।


কামাল ভাই ডিহাইড্রেশনে ভুগছেন। মাটিতে শুয়ে আর যাবে না বলছেন। শেষমেশ ২০ মিনিট পর সুস্থ হলে আবার ট্রেকিং শুরু করে ফুরমোন চূড়ার দিকে হাঁটা শুরু করলাম।


৮০ ডিগ্রি খাঁড়া ঢালু পাহাড়। সেলফি স্টিকে ভর করে উপরে উঠছি। থাই টান টান করছে। এই ঢালুতে বিশ্রাম ও করা যাচ্ছে না।মনে মনে সমতল খোঁজে চলছি। শরীর বিশ্রাম চাই।


২০ মিনিট পর একটি আমগাছের দেখা পেলাম। গা এলিয়ে শুয়ে পড়লাম। তখন দেখি উপর হতে আরেক অভিযাত্রী দল পাহাড় বেয়ে নামছে। সে দলে ৩ জন মহিলা। তাদের ট্রেকিং ক্ষমতা দেখে মুগ্ধ হলাম।


পাহাড়ি পথে হাঁটা খুবই কষ্টকর ছিল। আশেপাশে কোনো মানুষজন ছিল না, দলের সবাই বিছিন্ন হয়ে যাচ্ছে।


উপত্যকা বেয়ে হাঁটছিলাম, মাঝে মাঝে বসছিলাম, পানি ও স্যালাইন খাচ্ছিলাম। পাহাড় আমাদের সাদরেই গ্রহণ করেছিল।

সুনশান পরিবেশ, মৃদুুমন্দ বাতাস আর সাথে ছিল তীব্র রোদ।

এমন সময় খারাপ খবরটি এল। দলের ইমন বমি করতে করতে ঢালুতেই শুয়ে গেছে। কামাল ভাই গিয়ে সাহায্য করলেন। চোখ বন্ধ করে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে ইমন।


বেকায়দায় পরে গেল দলের সবাই। আশেপাশে কোন বসতি ও নেই। আরো ৫০০-৬০০ ফুট উঠা বাকি। এখন নেমে যাওয়া ও অসম্ভব।
৭০% পথ যাওয়ার পর আর সম্ভব না ভেবে ফিরে যাবার চিন্তা করা যাবে না। ফিরে যেতে নিষেধ করে আসার জন্য সবাই উৎসাহ দিল।


কোন ভাবে ইমনকে হুঁশ করে হাঁটা শুরু হল। মনের মধ্যে একটা সংকল্প-যত কষ্টই হোক ফোরমোনের চূড়ায় উঠবই।

৩০ মিনিট পর..

উঠে এলাম ৩ বটবৃক্ষের একটি সমতল জায়গায়!!


তখনি বিজিবি অফিসার আবচার একজনের মোবাইলে ফোন দিয়ে বলল:

“তোমরা এখন বটতলায় না? ওখানে রেস্ট করে আবার উঠা শুরু কর। সমস্যা হলে ফোনে জানবে”

অবাক হলাম অফিসারের কথায়। খালি চোখে নিচের ক্যাম্প হতে আমাদের অবস্থান দেখে ফেলেছেন। এটা কিভাবে সম্ভব??

(স্যালুট বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ)


আবার উঠা শুরু করলাম। সামনে ছিল বাঁশখালীর ওসমান ভাই। পাতলা গড়নের এই ভাইটি প্যান্ট শার্ট ইন্ করে শো পরে ট্রেকিং এ এসেছেন। প্রথমে হাসি পেলেও পরে দেখলাম উনি আমাদের সবার চেয়ে ভাল ট্রেকিং করছেন। আমরা যখন রেস্ট চাই, উনি তখন সেলফিতে ব্যস্ত। কোন রেস্ট না।


১০ মিনিট হেঁটেই উঠে এলাম ফুরমোনের বিজিবি ক্যাম্প।


ভেতরে প্রবেশ নিষেধ। নিচ হতে ইমনকে ও তুলে আনা হল। মানিক ভাই অফিসার আবচার ভাইকে ফোনে ইমনের অবস্থা জানালেন।
সাথে সাথে আবচার ভাইয়ের সহায়তায় ক্যাম্প হতে একটি মেডিকেল টিম চলে এল। কিছুক্ষণের ট্রিটমেন্টে ইমন সুস্থ হল।

ইতিমধ্যে ১৪ লিটার পানি শেষ। ক্যাম্প হতে ৫ লিটার পানি পাওয়া গেল।

তখনো চূড়াই উঠা বাকি। মানিক ভাই ও ইমনকে রেখে আবার রওয়ানা দিলাম। এই পথটায় বিপদজনক। বিজিবির এক অফিসার নিষেধ করলেও জাহেদ ভাইয়ের অসম্ভব সাহস নিয়ে সবাই এগিয়ে চললাম।


অবশেষে ২০ মিনিট পর একেবারে পাহাড় চূড়ায় গিয়ে পৌঁছালাম। সেখানে গৌতম বুদ্ধের মূর্তিসম্বলিত বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের একটি বিহার রয়েছে।

কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, কোথাও জনমানব নেই। শুধু আমরা ৫ জন। বিহারে ডুকে গৌতম বৌদ্ধের পাশে ছবি তুললাম। গৌতম বৌদ্ধের কোন মূর্তির এতকাছে যাওয়া সম্ভব হয়নি কোনদিন। হাতে ছুঁয়ে দেখলাম।। ভয় ও করল। তবে এই ভয়ের মাঝে ভালবাসা প্রচুর।


একটি প্রদীপ হাতে নিয়ে দেখলাম। খুব সুন্দর। পাশে রাখা একটি বক্সে কিছু টাকা ও দিলাম। বিহারের আঙিনায় বসে আমরা সবাই বিশ্রাম নেই। খাওয়া-দাওয়া ও ফটোসেশন হলো অনেক।

আশপাশে থাকিয়ে অবাক হলাম.. ফুরমোন চূড়া হতে পর্বত শ্রেণী পরিবেষ্টিত রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলাকে এক নজরে দেখা যাচ্ছে। উপত্যকায় বন ও লতায় আকীর্ণ বুক চিরে বয়ে চলেছে দূরের কর্ণফুলী। উত্তরে ভারতের ত্রিপুরা ও মিজোরাম এখান হতে বেশ চোখে পড়ছে। দক্ষিণে বান্দরবানের পাহাড়সারি..

পশ্চিমে চট্টগ্রাম শহর স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।
মুগ্ধ হলাম ফুরমোনে। এবার ফেরার পালা।


আমরা বিকাল ৩ টার দিকে চূড়া থেকে নামতে শুরু করি। নামার সময় ৩ বটবৃক্ষের পাশ দিয়ে যাওয়া একটি রাস্তায় ঝর্ণা পেলাম। সাথে সাথে গোসলে মেতেছি কয়েকজন। অসম্ভব ঠান্ডা জল। নিমিষেই ক্লান্তি দূর হয়ে চাঙ্গা হয়ে গেলাম।


পাহাড়ে ওঠাটা চ্যালেঞ্জিং ছিল, কিন্তু পাহাড় চূড়াই উঠার মজাই আলাদা।

পাহাড়ে ট্রেকিং এ যে কষ্ট ছিল, তা এক নিমিষেই মিলিয়ে যায় চূড়ায় উঠে। অপূর্ব সৃষ্টি, অপূর্ব ফুরমোন।

আল্লাহ পাক যে এতই মহান, আবারো বুঝতে সক্ষম হলাম ফুরমোনের চূড়াই।

আবারো যেন হাতছানি দিয়ে ডাকে ফুরমোন।

অপূর্ব বাংলার রুপ। তাইতো বলি.. মুরি আর বাজি এ দেজচান আমার”! ন চাঙ যেবার এই জাগান ছাড়ি….