কেওকারাডং_সামিট

কেওকারাডং_সামিট

_নীল জামশেদ

মুরি আর বাজি এ দেজচান আমার, ন চাঙ যেবার এ দেজচান চাড়ি…

এবারের অভিযান দেশের অন্যতম পর্বতশৃঙ্গ কেওকারাডং সামিট।

১৫ কেজি ওজনের ব্যাগপ্যাক, বাসে ঝুলে রুমা, পচা ডিমের ভাত, সেনাবাহিনীর অনুমতি না দেয়া, দার্জিলিং পাড়ায় বম শিশুদের সাথে বম ভাষায় কথা বলা, হুক্কার স্বাদ নেয়া, ১৩ কি.মি পায়ে হেঁটে কেওকারাডং জয়, সেখানের কারবারি লালা বমের স্বাক্ষাত, সাঙ্গু, বগালেক, চিংড়ি ঝর্ণায় হাড় কাঁপানো জলে গোসল সব মিলিয়ে কেওকারাডং ট্যুরে ছিল অতিরিক্ত এ্যাডভেঞ্চার।

ট্যুরের শুরুতেঃ

২১.০২.১৯

একুশের সকাল।
প্রতিদিনের মতো আজো সূর্যটা লাল। কিন্তু কেন জানি মনে হচ্ছে আজকের আভায় ভাষা শহীদদের প্রতিবাদের সেই তীব্র লাল ছোঁয়া একটু বেশি। যেটা নাকি আমাদের বারবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে ভাষার জন্য রাজপথ রঞ্জিত করার ইতিহাস একমাত্র বাঙালী জাতির।

শেষরাতে গুছিয়ে রাখা ব্যাগপ্যাক নিয়ে রওয়ানা হয়েছিলাম পাহাড়ের পথে।

গন্তব্য বান্দরবান-রুমা-রিজুক ঝর্ণা-বগালেক-দার্জিলিং পাড়া-কেওকারাডং-পাসিংপাড়া-তাজিংডং হয়ে থানছি।

(আজকের প্লানঃ চট্টগ্রাম হতে বান্দরবান যাওয়া। সেখান হতে ৪৮ কি.মি দূরে রুমাবাজার। এরপর চান্দের গাড়িতে ১৭ কি. মি দূরে বগালেক গিয়ে রাতকাটানো।)

পিঠের বোঝা আঁচ করে বুঝলাম অন্যান্যবারের চেয়ে এবারের ব্যাগপ্যাক ভারী। হয়তো শীতের ভয়ে নেয়া অতিরিক্ত সুয়েটার ভারী করে তুলেছে।

সবমিলিয়ে ১৫ কেজি ওজনের ব্যাগটা নিয়ে আমরা যখন বান্দরবান শহরে পৌঁছালাম ঘড়িতে তখন দুপুর ১ টা। সাথে আছে আনোয়ারুল আজিম চৌধুরী মাসুদ ভাই, কামাল ভাই, মানিক ভাই ও জাহেদ ভাই।

আমাদের ৫ জনের ‘যেখানে রাইত সেখানে কাইত’ টাইপ ট্যুরে আমরা কখনো আগেভাগে রুম বুকিং, গাড়ি ভাড়া করিনা। যার কারণে ট্যুরটা অদ্ভুত রকমের সুন্দর হয়।

বান্দরবান শহরের রুমা বাস স্টেশন পৌঁছে ঝটপট দেড়টার বাসের টিকেট কাটা হয়ে গেল।
খিদায় ছোঁ ছোঁ করতে থাকা পেঠে তখনি কিছু পুরার সময় হয়েছিল। খেয়ে সোজা বাসে।

মনের মধ্যে ভয় হচ্ছিল ৪ টার আগে যদি রুমা বাজার পৌঁছাতে না পারি তাহলে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী আমাদের রুমা বাজার হতে বগালেক যাওয়ার অনুমতি দিবেনা। কারণ নিরাপত্তার জন্য ৪ টার পর আর রুমা বাজার হতে বগালেক ও কেওকারাডং যাওয়ার অনুমতি নেই।

আঁকা বাঁকা পাহাড়ি পথ বেয়ে চলছে বাস। ইঞ্জিন বক্সে বসে এক বম মহিলা তার ৭ বছরের মেয়েকে নিয়ে হইহুল্লোড়ের মধ্যে দিব্যি ঘুমুচ্ছে। পথবেয়ে উপজাতী মহিলারা ফলফলাদি নিয়ে বাজার পানে ছুটছে খদ্দরের আশায়। ওয়াই জংশন ফেরিয়ে বাসের গতি আরো কমতে থাকলো।

খাড়া পথ। একটু ভুল হলেই বাস নেমে যাবে উপত্যকার কোন ভয়াল খাদে। দক্ষ চালক খুব ধীরে ধীরে তার অভিজ্ঞতার দাপটে বাসকে পাহাড়ের পর পাহাড় তুলছে আর নামছে।

শেষমেশ আমরা ৪ টা ৩০ মিনিটে রুমা বাজার, কামাল ভাই ছুটলো সেনাবাহিনীর ক্যাম্পে।

দেখি অনুমতি পাই কিনা???

বুঝতেই পারছেন আমরা ৩০ মিনিট লেইট করেছি।
নানা তদবিরের পরেও সেনাবাহিনী অনুমতি দিলো না। সবার মন ভেঙ্গে গেল বাংলা সিনেমার বাপ্পারাজের মতো। নিজেকেও তার মতো অপরাধী মনে হচ্ছে। বড্ড দেরী করে ফেললাম।

তবু স্যালুট বাংলাদেশ সেনাবাহিনী।
( নিয়ম না ভাঙ্গার জন্য)

কি আর করা?
আজ রাতটা আর বগালেক যাওয়া হলো না। প্লান মিসিং। সকালে উঠেই বগালেক যাওয়া যাবে।

তখনই একটা খুশির খবর দিল কামাল ভাই ও জাহিদ ভাই। বললো আগামীকাল সকালে বগালেক যাওয়ার আগে আমরা রিজুক ঝর্ণা দেখে আসতে পারি। এটা বাড়তি পাওনা। তখনি সবাই আবার খুশিতে লাফিয়ে উঠলো। আজিম ভাইয়ের মুখে বাংলা সিনেমার নায়ক জসিমের মতো লটারী জেতার হাসি। সবাই উচ্ছ্বসিত।

২২.০২.১৯

সকালে #রিজুক_ঝর্ণা

রুমা বাজারে রাত কাটিয়ে সকাল সকাল নৌকা নিয়ে ছুটলাম রিজুক ঝর্ণার দিকে।
প্রায় ২০০ ফুট উঁচু থেকে চমৎকার শব্দ করে সারাবছর সাঙ্গু নদীতে পড়ে রিজুক ঝর্ণার পানি। স্থানীয় ভাষায় এই ঝর্ণাকে রিসংসং বলা হয়।
রিজুক ঝর্ণার পানি মুক্তার মত চকচকে যা প্রকৃতির সৌন্দর্যের এক অনন্য নিদর্শন। বিভিন্ন রকমের গাছ ও উদ্ভিদ রয়েছে এই ঝর্নাটিকে ঘিরে। বছরের যে কোন সময় এই ঝর্ণাটি দেখতে যেতে পারেন তবে বর্ষাকালে এখানে আসলে রিজুক ঝর্ণার সৌন্দর্য সত্যিকার অর্থে উপভোগ করতে পারবেন।

রিজুক শেষে ৯ টার আগে সবাই রুমা বাজার হাজির। ট্রেকিং এ সারাদিন গায়ের উপর দখল যাবে ভেবে প্রস্তুতি নেয়া শুরু করলো সকলে৷
রুমায় নাস্তা সেরে পরবর্তী গন্তব্য ১৭ কি.মি দূরে বগালেক।

বগার পানেঃ

রুমাবাজার হতে বগালেক ১৬ কি.মি যেতে যতই না এ্যাডভেঞ্চার ছিল। তার চেয়ে ভয়াল ছিল বগালেকের চূড়াই যখন ফোর হুইলার ইঞ্জিনের চান্দের গাড়ি সবাইকে ভয় লাগিয়ে উপরের দিকে উঠছিল। প্রায় ১ কি.মি খাড়া এই পথটি বাংলাদেশের খাড়া পাহাড়ি রাস্থার মধ্যে সবচে ভয়ংকর। যা সাজেক ও ডিমপাহাড়কে ও হার মানায়।

ধীরে ধীরে উঠছিল গাড়ি৷ আমি ছিলাম ছাদে। তবে কয়েকবার ছাদে করে পাহাড়ি রাস্থায় ঘুরার সুবাদে ভয়ডর ছিল না। গাড়ির স্লো মোসন্ দেখে নেমে পড়লাম রাস্থায়।

আস্তে আস্তে উঠছে গাড়ি। নেমেই বুঝলাম খুব খাড়া রাস্থা। হাঁটাটা ছিল খুব কষ্টকর।

বগালেকের পাশে একটি বম পাড়া (বগামুখপাড়া) এবং একটি মুরং পাড়া আছে। স্থানীয় আদিবাসীরা বম, মুরং বা ম্রো, তঞ্চংগ্যা এবং ত্রিপুরাসহ অন্যান্য আদিবাসী। স্থানীয় আদিবাসীদের উপকথা অনুযায়ী, অনেক কাল আগে পাহাড়ের গুহায় একটি ড্রাগন বাস করতো। বম ভাষায় ড্রাগনকে “বগা” বলা হয়। ড্রাগন-দেবতাকে তুষ্ট করতে স্থানীয়রা গবাদী পশু উৎসর্গ করতেন। কিন্তু একবার কয়েকজন এই ড্রাগন দেবতাকে হত্যা করলে চূঁড়াটি জলমগ্ন লেকে পরিণত হয় এবং গ্রামগুলোকে ধ্বংস করে ফেলে। যদিও এই উপকথার কোনো বাস্তব প্রমাণ নেই, তবুও উপকথার আগুন উদগীরণকারী ড্রাগন বা বগা এবং হ্রদের জ্বালামুখের মতো গঠন মৃত আগ্নেয়গিরির ধারণাটির সাথে মিলে যায়।

বগালেক পৌঁছে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো সবাই।
আর্মি ক্যাম্পে নাম এন্ট্রি করে এবার ছুটতে হবে কেওকারাডং এর পথে। দুপুরের খাবার সারা হলো স্থানীয় বম হোটেলে। আলুবর্তা, তেঁতুল চাটনি, বেগুন ফ্রাই, ডিমের সাথে ডাল।

সূর্য তখন ঠিক মাথার উপরে।

সামনে বাকি ১৩ কি.মি পাহাড়ি পথ। খাড়া উপত্যকা বেয়ে যদি পাহাড়ের উপর উঠা

যায় তাহলেই হবে কেওকারাডং সামিট।

কেওকারাডং চূড়া জয়ের পথেঃ

এটাই সবচে বড় ট্রেকিং৷
হাঁটতে হবে ১৩ কি.মি। ঘড়িতে ৩ টা বাজে। তাড়াতাড়ি হাঁটা শুরু না করলে কেওকারাডং উঠার আগেই জঙ্গলে রাত নামবে। গাইড সবাইকে তাড়াতাড়ি করতে বললেও অনেকে বগালেকে ছবি তুলতে ব্যস্ত।

সে ফাঁকে বেশ কিছু দৃশ্য ধারণ করলাম বগালেকে।

তারপর হাঁটাশুরু।

১ ঘন্টা পর…

আমি আর মানিক ভাই বুদ্ধি করলাম যত তাড়াতাড়ি হেঁটে পথ অতিক্রম করা যাবে, ততো আমরা সামনের চিংড়ি ঝর্ণায় অবস্থান করতে পারবো। আর এগিয়ে থাকবো কেওকারডং এর পথে। দেরী হয়ে গেলে আমরা চিংড়ি ঝর্ণা না দেখেই যেতে হবে কেওকারাডং।

সে আশাই বাকিদের পেছনে ফেলে আমি আর মানিক ভাই সবার আগে এক ঘন্টায় পৌঁছে গেলাম চিংড়ি ঝর্ণা। বাকিরা তখন অনেক পিছিয়ে।

চিংড়ি ঝর্ণা: পাহাড়ের বিশালতার মাঝে নান্দনিক এক ফুল

মায়াবী প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, পাহাড় আর মেঘের মিতালী, সবুজ বৃক্ষরাজির দীপ্তিময় ছায়া এইসবই অপরূপ বান্দরবানকে করেছে পর্যটন শিল্পের অন্যতম আকর্ষণ। প্রকৃতির বিশালতায় নিজেকে হারাতে ভ্রমণ পিপাসুরা ছুটে যায় পার্বত্য চট্টগ্রামের এইসব অঞ্চলে।

উঁচু উঁচু পাহাড় গুলো যখন প্রকৃতির বিশালতা প্রকাশ করছে আর তখন সেই বিশালতার বুকে নান্দনিক এক ফুলের মতো ফুটে আছে অনেক শীতল জলধারা। এখানকার গহীন পাহাড়ের বুকে লুকিয়ে থাকা ঝর্ণা গুলোর মধ্যে একটি চিংড়ি ঝিরি ঝর্ণা।

রুমা উপজেলায় বগা লেকের খুব কাছেই অবস্থিত এই চিংড়ি ঝর্ণাটি। অপরূপ বগা লেক থেকে এক ঘণ্টার দূরত্বে রয়েছে এটি। বিশাল পাথুরে পিচ্ছিল পথ পাড়ি দিতে হবে চিংড়ি ঝর্ণার নিকটে যেতে হলে।

চিংড়ি ঝর্ণা অবগাহনের পর যখন বের হলাম, তখন দেখলাম দলের বাকির পাহাড় বেয়ে একে একে নামছেন। আজিম ভাই এর মুখ থেকে একটি সংবাদ শুনে মন খারাপ হয়ে গেলে। আমাদের ১৬ জনের টিমের ১ জন হাটঁতে না পারায় মাঝপথেই বেক করেছে। বগালেকগামী একটি টিম ওনাকে সাথে নিয়েছে।

সবমিলিয়ে চিংড়ি ঝর্ণা দেখার পর আবার ট্রেকিং শুরু..

আরো ৩ ঘন্টার পাহাড়ি খাড়া পথ। সূর্য হেলে পড়েছে। জোর কদমে পা ফেলার তাগিদ গাইডের। এবার দল থেকে বিচ্ছিন্ন না হয়ে একসাথে সবাই।

পথিমধ্যে দেখা যাচ্ছে অনেক পর্বতারোহী। ঢাকা থেকে মেয়েদের ২০ জনের একটি গ্রুপ এসেছে কেওকারাডং সামিটে। তারা ও বেশ স্বাচ্ছন্দ্যে এগিয়ে যাচ্ছে। চিংড়ি ঝর্ণার ২ ঘন্টা পর উঠে এলাম লুমতং পাহাড়ের চূড়ায়। সেখানে ডিম, পানি খেয়ে শুয়ে পড়লাম মাঠিতে। এত খাড়া ট্রেইল সত্যিই সবাইকে হাঁপিয়ে তুলছে। তখনি গাইড দক্ষিণ দিকে একটি খাড়া পাহাড় দেখিয়ে বললোঃ ঐ যে কেওকারাডং। সাহস এল মনে। আবার পথ চলা৷

এর ২ ঘন্টা পর পেলাম নান্দনিক সৌন্দর্য্যের বাংলাদেশের সবচে সুন্দর পরিচ্ছন্ন দার্জিলিং পাড়া। (দার্জিলিং পাড়া নিয়ে পরবর্তীতে বিস্তারিত লিখবো)

দার্জিলিং পাড়ায় তখন সন্ধ্যা নেমেছে। সেখান হতে ৩০ মিনিটের দূরত্বে কেওকারাডং।

হাঁপিয়ে উঠা পর্বতারোহীরা সকলেই উঠে চলছে।

রাত নেমেছে পাহাড়ে। আবছা অন্ধকারে শুনশান নিরবতা৷ কোথাও কেউ নেই। শুধু ট্রেকারদের লাঠির টকটক শব্দ। আর জুতোর আওয়াজ।

দার্জিলিং পাড়া হতে উপরে ১ কি.মি অন্ধকারে হেটেঁই মিললো কেওকারাডং চূড়া। দলের সবার মতো আজিম ভাইয়ের মনে আনন্দের ঘূর্ণিঝড়। ভয়কে জয় করে তিনিও তারুণ্যের শক্তিতে কেওকারাডং সামিট করেছেন।

ধীরে ধীরে সবাই চূড়াই উঠে এল।

রাত নামছে।

পাহাড়ী রাত।
কেওকারাডং এর কারবারি লালাবমের হোটেলে ট্রেকারদের আড্ডা জমছে।

নিচে অন্যান্য পর্বতারোহীরা ও একে উঠে জয়ের জানান দিচ্ছে…